ম্মরণীয়- বরণীয় স্বর্গীয় বিহারীলাল সাহা
বিহারীলাল সাহার পৈত্রিক বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের গির্দ্দাঘাট নামক একটি পল্লী গ্রামে। তাহার পিতার নাম স্বর্গীয় শিব চন্দ্র সাহা। পদ্মা বক্ষে গির্দ্দাঘাটের বাস্তুবিটা বিলিন হওয়ার পর শিব চন্দ্র সাহা কতিপয় জ্ঞাতি কুটুম্বের সঙ্গে ফরিদপুর জিলার ফটকিরপাড় নামক গ্রামে নতুন বাসস্থান নির্মাণ করেন। শিব চন্দ্র সাহার দুইটি কন্যা সন্তানের পর ১২৭৩ সনের ১৪ ফাল্গুন খ্রীষ্টিয় ১৮৬৭ সনের ২৫ ফেব্রæয়ারী তারিখে বিহারীলাল সাহা জন্ম গ্রহণ করেন। বিহারীলাল সাহার জন্মের কয়েক বছর পর ফটকির পারের বাড়ীটিও নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় শিবচন্দ্র সাহা নড়িয়ার মূলপাড়া নামক গ্রামে নতুন বাড়ী তৈরি করেন। কিছুকাল পরে মূলপাড়ার বাড়ীটিও নদীবক্ষে বিলিন হলে নড়িয়া গ্রামে নতুনভাবে বসতি স্থাপন করেন। বার বার নদী ভাঙ্গনের কারণে শিব চন্দ্র সাহা জমি জমা হারিয়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন। দারিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত বিহারীলাল সাহার বাল্যকাল অতিকষ্টে অতিবাহিত হয়।
বিহারীলাল সাহার অপর নাম রাসবিহারী সাহা, কিন্তু তিনি বিহারীলাল নামেই পরিচিত হন। বাল্যকালে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্র ছিলেন। তাই পাঠাভ্যাস আরম্ভ করিয়া অল্পকালের মধ্যেই নি¤œ প্রাইমারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিছুকালের মধ্যে পারিপার্শিক বাধা বিঘেœর মধ্যেও তিনি উচ্চ প্রাইমারী সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্বেও অভাবের তারনায় তিনি বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেন নাই। অর্থাভাবে পড়াশুনা বন্ধ হওয়া যে একজন মেধাবী ও তেজশ্বী ছাত্রের পক্ষে কতটা দুঃখের বিষয়, বালক বিহারীলাল সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং সেই কথা স্মরন রাখেন। পরবর্তীতে তাহার অবস্থা স্বচ্ছল হলে বহু দরিদ্র ছাত্রকে সাহায্য করেন এবং স্কুল পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার পথ সুগম করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। পরবর্তীতে নিজগ্রাম ও তন্নিকটবর্তী গ্রামের ছেলে মেয়েদের লেখাপরা, শিক্ষার অসুবিধা ও দেশে শিক্ষা বিস্তারের বিষয় নিয়া তিনি অনেক চিন্তা করিতেন। বিশেষত: বাল্যকালে অভাবের তাড়নায় তিনি নিজে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। তাই আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় অপরকে শিক্ষিত করিবার উচ্চাকাঙ্খা তাহার মধ্যে প্রবল হইয়া উঠে। তাই তিনি ইংরেজি ১৯১৯ সনের ২৯ শে জানুয়ারী তারিখে নিজ গ্রামে ”নড়িয়া বিহারীলাল উচ্চ বিদ্যালয় ” স্থাপন করেন। ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার ব্যাধি গ্রাম্য দলাদলিতে সংক্রামিত হইয়া স্কুল স্থাপনের পর হইতেই নানা ভাবে সমস্যা দেখা দেয়। বিহারীলাল সৎসাহসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই জিঘাংসা প্রসুত বহু বাধা বিঘœ অতিক্রম করিয়া প্রচুর অর্থ ব্যয়ে তিনি স্কুলের ভিত্তি সুদৃঢ় করিতে সমর্থ হন। স্কুল ঘর নির্মাণে তৎকালীন সময় তাহার ৪০,০০০/- (চল্লিশ হাজার) টাকা খরচ হয়। ইহা বলা অতিরঞ্জিত হইবে না যে, দলাদলির ক্লেশ গঞ্জনার পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধ সহানুভুতি পাইলে বিহারীলালের জীবদ্দশাতেই স্কুলটি কলেজে পরিনত হইত। বিহারীলাল সাহা ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণ করিতেন। শেষবারে তীর্থ ভ্রমণ করিয়া তিনি কলিকাতায় আসেন এবং বাংলা ১৩৩১ সনের প্রথম ভাগেই নানা পীড়ায় অসুস্থ হইয়া পড়েন। তাহাকে ১৩৩২ সনের মাঘ মাসের প্রথম দিকে তাহার পৈত্রিক নিবাস নড়িয়ায় নিয়া আসা হয়। পরবর্তীতে বেশী অসুস্থ হইয়া পড়ায় তাহাকে আর কোথাও স্থানান্তর করা সম্ভব হয় নাই। অবশেষে ১৩৩২ সনের ২২শে মাঘ উত্তরায়ন অষ্টমী তিথীতে রাত্রি ১টা ১০ মিনিটে ভগবানের নাম উচ্চারণ করিতে করিতে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে পরলোক গমন করেন। তাহার শেষ ইচ্ছা অনুসারে প্রিয় স্কুল প্রাঙ্গনেই তাহার অন্তোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইংরেজি ১৯২৯ সালে স্কুল প্রাঙ্গনে একটি কনফারেন্স উপলক্ষ্যে দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত উপস্থিত হন। সভার প্রারম্ভে তিনি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বিহারীলার সাহার প্রতিকৃতির আবরণ উন্মোচন করেন এবং তাহার কর্মময় জীবনের প্রশংসা করিয়া বলেন ”নিঃসার্থভাবে এত অর্থ ব্যয় করিতে খুব কমই দেখা যায়”।
দরিদ্র ঘরে জন্ম গ্রহণ করিয়াও এক জীবনে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় ও সদব্যয় করা বিহারীলাল সাহার মত ব্যক্তি দ্বিতীয়টি খুব কমই দেখা যায়। তিনি এদেশের শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন করিয়াছেন। তাই তিনি তাহার সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের মাঝে মরিয়াও অমর হইয়া থাকিবেন চিরদিন।